মঙ্গলবার, ২৮ মে ২০২৪, ০৯:৪৯ অপরাহ্ন

তালেবান : অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

তালেবান : অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

স্বদেশ ডেস্ক:

গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে আফগান সীমান্তঘেঁষা পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসায় তালেবানের অঙ্কুর হয়েছিল। আজ তা মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ধর্মীয় ইসলামি কট্টর ওহাবি মতবাদে সৌদি আরবের প্রধান আর্থিক সহায়তায় নিরন্ন আফগান পরিবারের শিশুদের তালেব বা শিক্ষার্থী হিসেবে যুক্ত করে স্বপ্ন দেখানো হতো আফগানিস্তানে ‘ইসলামি আমিরাত’ প্রতিষ্ঠার। ধর্ম শিক্ষাকে আশ্রয় বা অবলম্বন করলেও তালেবানের যাত্রার দীর্ঘপথের রোডম্যাপ ছিল নেতাদের মধ্যে। সোভিয়েতের উত্তর আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ, অরাজকতা ও মুজাহিদ নেতাদের নৈতিক স্খলন ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে ৯৯ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যার দেশ আফগানিস্তানে ছিল একটি স্থিতিশীল সরকারের অনুসন্ধান। এই সুযোগ লুফে নিয়েছিল তালেবান। তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমর আন্দোলনের সূত্রপাত করেন ‘অ-ইসলামিক’ কর্মকাণ্ডের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। মাত্র ১৬ সঙ্গী নিয়ে চাঁদাবাজি, রাহাজানি প্রতিহতের আন্দোলন শুরু করেন। সঙ্গত কারণেই স্বপ্রণোদিত হয়ে অনেক যুবক এ কাজে যুক্ত হন। তাদের জন্য এটা ছিল সমাজ সংস্কারমূলক একটা কাজ। কিন্তু নেতৃত্বে থাকা তালেবানের মনকুঠিরে বিরাজ-বাসনা ছিল ইসলামি আমিরাত কায়েম করা।

আফগানিস্তানে পটপরিবর্তন শুরু হয় (১৯৭৯-৮৯) রাশিয়া-আফগান যুদ্ধে। আফগানিস্তানের তৎকালীন সোশ্যালিস্ট সরকার ছিল রাশিয়ার মদদপুষ্ট। আমেরিকা চেয়েছিল ওই সরকার রক্ষায় রাশিয়া-আফগান যুদ্ধে জড়াতে, ফায়দা লুটতে। আমেরিকা চেয়েছিল আফগানদের দিয়েই আস্তে আস্তে দুর্বল করে রুশ সম্রাজ্যকে দ্রুত ভাঙনের মুখে ঠেলে দিতে। সহায়ক শক্তি হিসেবে মুসলিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল আফগান মুজাহিদের সহায়তার জন্য। কমিউনিস্ট গনচীন নিজ স্বার্থেই আফগানিস্তানের ইসলামিক সংগঠনগুলোকে ঝিনজিয়াংয়ের উইঘুর মুসলমানদের মাধ্যমে সাহায্য করেছিল। আমেরিকা আফগান মুজাহিদদের অর্থ, জনবল ও অস্ত্রের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। আমেরিকার গোয়োন্দা সংস্থা সিআইএর (ঈওঅ) তত্ত্বাবধানে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই (ওঝও) আফগান মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে। এভাবেই সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধ পরিকল্পনা চলে। আফগান মুজাহিদরা ওই যুদ্ধকে জানবাজি জিহাদ হিসেবে গ্রহণ করে। এক দশক যুদ্ধের পর মুজাহিদিন সরকার প্রতিষ্ঠা হলেও তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতিকে প্রতিহত করতেই তালেবানের উত্থান। আফগান বিভিন্ন মুজাহিদিন গ্রুপের অনৈক্যের পরিপ্রেক্ষিতে তালেবানকে ইসলামি ভাবাবেগে উজ্জিবীত করে কাবুল বিজয় করে ১৯৯৬ সালে। কিন্তু ২০০১ সালে আমোরিকার হামলার পর মার্কিন জোটের আক্রমণে তালেবানের পতন ঘটে। বাস্তবতা হচ্ছেÑ তালেবান ওই যুদ্ধে হেরে যায়নি, বরং প্রচলিত যুদ্ধের রণকৌশল পাল্টিয়ে পশ্চাৎপসারণ ঘটিয়েছে। তারা নিজেদের নিরাপদ করতে পাকিস্তানের দক্ষিণ ও পশ্চিম আফগানিস্তানে ঘাঁটি গড়ে তোলে। ২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেনের হত্যা এবং ২০১৩ সালে করাচির হাসপাতালে তালেবানপ্রধান মোল্লা ওমরের মৃত্যুর পরও তালেবানের সাংগঠনিক ভিতের তেমন ক্ষতি হয়নি, বরং তালেবান নিজেদের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে পাকিস্তানে তেহারিক-ই-তালবান নামে শাখা প্রতিষ্ঠা করে হাকিমুল্লাহ মেহমুদকে দায়িত্ব দিয়েছে। পাকিস্তানেও তালেবান অসংখ্য আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমের বিস্তীর্ণ এলাকায় তালেবানের শক্ত অবস্থান অটুট রেখেছে।

তালেবান তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করে ২০২০ সালে দোহা চুক্তির পর পুরো আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা স্থির করে। তাদের রণকৌশল চমকপদ। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তালেবান আগে থেকেই আফগান জনগণের সঙ্গে মিশে এক ধরনের সামাজিক সখ্য গড়েছিল। জাতিগত পুশতুন আধিক্য তালেবান উজবেক, তাজিক ও হাজরা সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলে ধর্মীয় মেলবন্ধনে আফগানদের মধ্যে ইসলামি জাগরণের বীজ রোপণ করেছিল। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দোহা চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকার সৈন্যদের আফগান ছাড়ার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট হলে তালেবান নিজেদের সংখ্যাধিক্য এলাকার বদলে শক্তি বৃদ্ধি ও আক্রমণ করতে থাকে আফগানের উত্তর-পশ্চিমের প্রদেশে- যেখানে সরকারি বাহিনী শক্তিশালী। তালেবান জানত- যদি শক্তিশালী অবস্থানে একবার চিড় ধরানো যায়, তা হলে দুর্বল অবস্থানগুলো কব্জা করা কষ্টকর হবে না। তালেবানের এ রণকৌশল লাগসই ফল দিয়েছে। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে একের পর এক আফগান বিভিন্ন প্রদেশ জয় করে গত ১৫ আগস্ট অনেকটা বিনা প্রতিরোধে কাবুল জয় করে। উল্লেখ্য, পুশতুন সংখ্যালঘু প্রদেশ বাদাখশান, তাখার, কুন্দুডা ও জারাঞ্জর মতো অঞ্চল দখল করেছে জাতিগত মধ্যস্থতার মাধ্যমে।

তালেবান ঝড়ের গতিতে আফগানিস্তান দখলের বিষয়ে মার্কিন সামরিক বাহিনীর জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যন জেনারেল মার্কমিলি কংগ্রেসের শুনানিতে বলেন, আফগানিস্তানে আমাদের যুদ্ধ ছিল কৌশলগত ব্যর্থতা। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো আফগান সামরিক বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে মার্কিন বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল করে ফেলা। অথচ আফগান সামরিক বাহিনীকে গড়তে ২০২০ সালেই ব্যয় হয়েছিল ছয় বিলিয়ন ডলার- যার সদস্য সংখ্যা ৩ লাখ। পক্ষান্তরে মাত্র দেড় বিলিয়ন ডলারের ব্যয়ে গড়া তালেবান ৮৫ হাজার সৈন্য নিয়ে আফগান সৈন্যদের সামনেই দাঁড়াতে দেয়নি। আফগান সামরিক বাহিনীর সদস্যরা দেশমার্তৃকার জন্য নিবেদিত ছিল না। এ ছাড়া আফগান সৈন্যদের সমন্বয়ের অভাব, দুর্নীতি, মনোবলের সংকট, জাতিগত বিভেদের ও সংকটের ফলে সামরিক রশদ থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধে প্রতিরোধের শক্তি জোগায়নি।

আফগানিস্তানে দীর্ঘদিনের যুদ্ধে দেশটির সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে শুধু নতজানু করেনি, বরং দেশটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। বর্তমানে তালেবান ক্ষমতা দখল করলেও অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নানামুখী সমস্যায় তালেবান নিপতিত। অতিদরিদ্র, কূটনৈতিকভাবে বহির্বিশ্ব থেকে বিছিন্ন, সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট, দক্ষ-মেধাসম্পন্ন জনবলের ঘাটতি, মানবিক বিপর্যয় ইত্যাদি চ্যালেঞ্জের মুখে তালবান। এ ছাড়া নিজেদের সংহতি ধরে রাখাও কঠিন হচ্ছে তালেবানের। এর পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রুপের অসন্তোষ ও হামলা অব্যাহত রয়েছে।

তালেবানের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে খ্যাত কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তালেবানকে ইসলামি শাসন শিখতে পরামর্শ দিয়ে বলেন, কাতার একটি মুসলিম দেশ। সরকার পরিচালনা ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীদের সংখ্যাই বেশি। এসব বার্তা তালেবানের জন্য গুরুত্ববহ। বিশ্ববাসী যে দৃষ্টিতেই দেখুক, তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত- এটা বাস্তবতা। পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বলা যায়- তালেবান যে পদ্ধতিতে ধর্মীয় অনুশাসন রাষ্ট্রিক পর্যায়ে প্রতিপালন করতে চায়, তা কঠিন। আধুনিক কল্যাণরাষ্ট্রের জন্য তালেবানি ব্যবস্থা মোটেও জুতসই নয়। বাস্তবতা মেনেই জনগণের মত ও পথকে গুরুত্ব দিয়েই শাসননীতি স্থির করতে হবে তালেবানকে। তালেবানের এখন চলছে তুতীয় প্রজন্ম। প্রথম প্রজন্ম সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধ করেছে। দ্বিতীয় প্রজন্ম মাঠপর্যায়ের কমান্ডার- যারা বেড়ে উঠেছে যুদ্ধের পরিবেশে। এখন তালেবানের তৃতীয় প্রজন্ম- যারা বেশিরভাগ শরণার্থী শিবিরগুলোয় অমানবেতর পরিবেশে মাদ্রাসার নিম্নক্লাস ত্যাগ করে যুদ্ধকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। কাজেই কমান্ডারের নির্দেশেই ছিল ধর্ম। যুদ্ব আর হানাহানি ছাড়া কিছুই দেখেনি, এমনকি তাদের অনেকে নিজের অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাওয়ার সুযোগটিও পায়নি। বিজ্ঞান, ভূগোল ও আধুনিকার সুযোগ তালেবান পায়নি। ধর্মীয় উন্মাদনায় তালেবানকে উসকে দেওয়া হয়েছে। ইসলামের ভ্রাতৃত্ব, ঔদার্য, সহমর্মিতার মাধ্যমে বিশুদ্ধ ইসলামি দীক্ষা তাদের দেওয়া হয়নি।

আফগানিস্তানের কাছে রাশিয়া ও আমেরিকার মতো পরাশক্তি পশ্চাৎসারণ করেছে। আফগান যুদ্ধ কেন্দ্র করেই সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে পূর্ব ইউরোপমুক্ত তথাকথিত কমিউনিস্ট বা সোশ্যালিস্ট নাগপাশ থেকে জয়জয়কার হয় আমেরিকার নেতৃত্বের পুঁজিবাদী বিশ্বের। এর মধ্যেই পৃথিবী শৃঙ্খলিত হয় পুঁজিদাস হিসেবে। তালেবানিব্যবস্থা কোনোভাবেই আধুনিক সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনও বিশ্বের জন্য সুখকর নয়। বিশ্বমোড়ল আমেরিকা গণতন্ত্রের কথা বললেও তা তাদের পছন্দের গণতন্ত্র। সর্বজনীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তারা বিশ্বে চায় না। তারা তাদের পরামর্শের গণতন্ত্রের জন্য নৈতিক ও আর্থিক সমর্থন দেয়। তালেবানের উত্থানে আমেরিকার এক সময় সমর্থন ছিল। আজ তালেবান আমেরিকার উদ্দেশ্যে পরিপূরক নয় বলে তাদের দৃষ্টিতে মন্দ। তবে তালেবান সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংকটে রয়েছে। যে কোনো ধরনের উগ্রবাদী আচরণ সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক নয়। তা যদি হয় হিন্দু-মুসলিম ধর্মনির্ভর, তা হলে তা প্রগতির সারথি নয়। এর পাশাপাশি পুঁজিবাদী একক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক আমেরিকা কারও আপন নয়। নানা কার্যকলাপে কখনো আমেরিকাকে কারও কারও আপন মনে হয়।

পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তালেবান, আইএস একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বের প্রগতির স্বার্থে তালেবানিব্যবস্থাকে পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বিরত থাকা উচিত। এর পাশাপাশি করোনা-উত্তর নয়া বিশ্বব্যবস্থায় আমেরিকার পুঁজিবাদী দৃষ্টিতে বিশ্ব নির্মাণ নয়Ñ বরং নবায়িত দৃষ্টিতে অহিংস, ভেদহীন, পরিবেশবান্ধব, ক্ষুধামুক্ত ও প্রগতির সারথি বিশ্ব গড়ার পরিকল্পনা জরুরি।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877